০৪:০৪:৩৬ শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩
মো. রিজুয়ান: একদিন ক্যাম্পাসের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সিঁড়িতে আড্ডা দিচ্ছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া মো. রিজুয়ান ও তাঁর বন্ধুরা। এমন সময় এক পথশিশু এসে টাকা চেয়ে হাত পাতল। ঠিক তখনই রিজুয়ানের মাথায় একটি আইডিয়া এলো। এমন অসংখ্য ছোট ছেলে-মেয়ে রোজই কারো না কারো কাছে হাত পাতে। তাত্ক্ষণিক সাহায্য করে এদের চাহিদা সাময়িকভাবে মেটানো হয়তো সম্ভব। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভাবলে, এভাবে অন্যের কাছে হাত পেতেই গোটা জীবন কাটাতে হবে ওদের। তাই সাহায্য যদি করতেই হয়, এমনভাবে করতে হবে, যেন সত্যিকার অর্থেই পাল্টে যায় ওদের জীবন। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
কী করা যায়?
১৩ জুলাই ২০১৭। রিজুয়ান ও তাঁর বন্ধুরা মিলে ঠিক করলেন, পথশিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করবেন। কিন্তু তাঁদের মতো ১৫-২০ জন শিক্ষার্থীর পক্ষে সেই ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। তাই সমমনাদের খুঁজতে শুরু করলেন। বেশ কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের সঙ্গীসংখ্যা দাঁড়াল ১০০ জনের মতো। সবার আর্থিক সহায়তায় চট্টগ্রামের ষোলশহর স্টেশনের পাশে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য একটা ঘর ভাড়া করা হলো। এরপর স্টেশনের পাশের বস্তিতে গিয়ে বাচ্চাদের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে তাঁদের রাজি করালেন, যেন শিশুগুলোকে স্কুলটিতে পাঠানো হয়। সেখানে সপ্তাহে দুই-তিন দিন পড়ানোর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল শিক্ষার আলো ছড়ানোর এই গল্প।
আইডিয়া কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন
চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে আইডিয়াসংক্রান্ত এক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি)। সেখানে রিজুয়ান ও তাঁর দল উপস্থাপন করেন নিজেদের ভাবনা। দরিদ্র ও পথশিশুদের শিক্ষার সুযোগ দিতে দিনে ব্যক্তিপ্রতি এক টাকা করে অনুদানের আইডিয়া ছিল তাঁদের। এই সৃজনশীল ভাবনার জন্য প্রতিযোগিতায় তাঁরা জিতে নেন ‘বেস্ট আইডিয়া অ্যাওয়ার্ড’।
এক টাকায় শিক্ষা
প্রতিযোগিতার সাফল্যে নানা জায়গা থেকে ভালো সাড়া পেতে থাকেন তাঁরা। তত দিনে সদস্যসংখ্যা ২১৮ থেকে আরো বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে তাঁদের ‘এক টাকায় শিক্ষা’ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। এরপর ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে আরো দুটি ঘর ভাড়া নেওয়া হয়। সেখানে এখন অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শিহাব জাহিনের তত্ত্বাবধানে সপ্তাহে চার দিন তিন শিফটে শিশু শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় আশপাশের কলোনিগুলোর দরিদ্র শিশুদের। পাশাপাশি ৭০-৮০ জন শিশুর পড়াশোনার সামগ্রিক খরচও বহন করে ফাউন্ডেশনটি।
ভাবনায় রদবদল
ক্যাম্পাস স্টেশনে আগে সব সময় ঘুরে বেড়াত রিফাত নামের ছয়-সাত বছরের এক শিশু। রিজুয়ান ওকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন একটি স্কুলে। সেই সঙ্গে স্কুলড্রেস, ব্যাগসহ প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী কিনে দেওয়া হয়েছিল ওকে। কয়েক দিন ভালোভাবেই স্কুলে আসা-যাওয়া করেছিল রিফাত। কিন্তু একসময় সে লাপাত্তা! এই অভিজ্ঞতা থেকে রিজুয়ানরা ভাবনায় কিছুটা রদবদল ঘটালেন। বুঝতে পারলেন, শুধু স্কুলে পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দিলেই শিক্ষা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয় না। শিক্ষা অর্জনে সহায়ক—এমন কিছু সুযোগও দিতে হবে এই শিশুদের। খাবার, প্রাথমিক চিকিত্সা, পড়ালেখার সরঞ্জাম পৌঁছে দিতে হবে ওদের কাছে, যেন অভাববোধ থেকে পড়াশোনা ছেড়ে না দেয়।
নতুন ভাবনার বাস্তবায়ন
নতুন ভাবনা বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত আটটি স্কুল ক্যাম্পেইন করেছে ফাউন্ডেশনটি। এর মধ্য দিয়ে এক হাজারজনেরও বেশি নতুন শিশুর দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরা; বিশেষত যে শিশুদের মা-বাবা নেই। এ ছাড়া এনায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ২৪ শিক্ষার্থীকে টেস্টপেপার কিনে দেওয়া ও ফ্রি কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা, উদালিয়া মইনিয়া আহমদিয়া মাদরাসার ১১০ জন শিশুর শিক্ষাসামগ্রী কিনে দেওয়া এবং সাতঘরিয়া আবদুল গনি ভূঁইয়া কমপ্লেক্স দাখিল মাদরাসার ২০ জন শিক্ষার্থীকে মাদরাসা নির্ধারিত পোশাক কিনে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তীচ্ছু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারেও সাহায্য করেছেন তাঁরা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চিকিত্সক মুকিত ওসমানের সহয়তায় ১০০ জন শিশুকে বিনা মূল্যে চিকিত্সা ও ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ফাউন্ডেশনটি।
অ্যাম্বাসাডর ও বিভিন্ন শাখা
ফাউন্ডেশনকে আরো গতিশীল করে তুলতে নতুন একটি ভাবনার সংযোজন ঘটেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০টি ডিপার্টমেন্টের পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সংগঠনটির অ্যাম্বাসাডর হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। নিজ নিজ ডিপার্টমেন্টে ‘এক টাকায় শিক্ষা ফাউন্ডেশনে’র প্রতিনিধিত্ব করা এবং অন্তত ২০ জন নতুন সদস্যকে ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত করা তাঁদের প্রাথমিক দায়িত্ব। ফলে শিগিগরই সদস্যসংখ্যা ২২০০ থেকে চার হাজারে উন্নীত হওয়ার আশা করছেন তাঁরা। এদিকে প্রধান শাখার বাইরে ফেনী, কক্সবাজার ও বরিশালে আরো তিনটি শাখায় চলছে ফাউন্ডেশনটির অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম।
বিনা সুদে ঋণ
অর্থসংকটের কারণে সময়মতো পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারেন না, সেমিস্টার ফি দিতে ব্যর্থ হন কিংবা নানা সংকটে পড়েন—বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষার্থীও রয়েছেন। তাঁদের সুবিধার জন্য বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা রেখেছে এই ফাউন্ডেশন।
ঈদ উপহার
এ বছর ঈদে বান্দরবান, বরিশাল, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে প্রায় ৩৫০ জন পথশিশুকে নতুন জামা উপহার দিয়েছে ফাউন্ডেশনটি।
নতুন পরিকল্পনা
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হানিফ সিদ্দিকীর সহযোগিতায় দুটি মোবাইল অপারেটর কম্পানির সঙ্গে একটি বিশেষ প্রস্তাবনা নিয়েও কথাবার্তা চলছে ফাউন্ডেশনটির। সেটি বাস্তবায়ন হলে প্রতি মাসে পাঁচ-সাতটি স্কুলে নিয়মিত ইভেন্ট এবং এক হাজারেরও বেশি টাকার অভাবে পড়তে না-পারা শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে। পাশাপাশি সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ সহজ হয়ে উঠবে। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের নামে একটি অ্যাপস তৈরির কাজও চলছে। সদস্যসহ যে কেউ চাইলেই সেই অ্যাপস ব্যবহার করে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, হিসাব-নিকাশসহ সব তথ্য জানতে পারবেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ শুরু করেছে ‘এক টাকায় শিক্ষা’ ফাউন্ডেশন। সেই সূত্রে আপাতত বেছে নেওয়া হয়েছে পটুয়াখালী, কুমিল্লা ও রংপুরকে। এসব অঞ্চলে পুরোদমে কাজ শুরু হবে শিগগিরই। ভবিষ্যতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন রিজুয়ান ও তাঁর বন্ধুরা।-কালের কণ্ঠ